বক্তাদের ক্ষেত্রে "শব্দচয়ন" বড় একটা ব্যাপার। আবার তিনি যদি ইসলামিক বক্তা হোন তাহলে তো কোন কথাই নেই,উনাকে শব্দচয়নের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। কিভাবে, কোথায়, কখন কি কথা বলতে হবে,কি বলা উচিত, কি বলা উচিত নয়- উনাকে এটা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। আবার বক্তার সেই ভূল শব্দচয়নে জন্য বিপথগামী হতে পারে অনেকেই।
যেমন ধরুন,এখন যদি আপনি বলেন- জান্নাতে মদ খাওয়া জায়েজ (নাউজুবিল্লাহ)।এটা শুনতে নিশ্চিত ভাল লাগার কথা নয়? এখন যদি কোন যুবকের মাথায় এটা ঢুকে যায় যে, হুজুরের বক্তব্যে তো শুনলাম জান্নাতে মদ খাওয়া জায়েজ তাহলে দুনিয়ায় খেলে কি আর এমন হবে। তাহলে বুঝুন ব্যাপারটা কি হতে পারে।আবার সেই হুজুরই যদি মদের জায়গায় শরাব বলেন, পাশাপাশি সেই শরাব খেতে কেমন হবে সেটা ও যদি বলে দেন, তাহলে এমন ভাবার প্রশ্নই আসবে না তার। মনে রাখা উচিত, সাইকোলোজি বা মনোবিজ্ঞানের ভাষায় মানুষের মনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো- চেতন মন (Conscious mind) ও
অবচেতন মন (Sub-Conscious mind)। উপরের অংশটি হলো চেতন মন, আর ভেতরের স্মৃতি সংরক্ষণ ও বিশ্বাস গঠনের অংশটি হলো অবচেতন মন। আর এই অবচেতন মন অনেক কিছু ধরে রাখে। আমাদের তাই শব্দচয়ন মারাত্মক একটা বিষয়।
একটা উদাহরণ দিলে বেশি বুঝতে সহজ হবে।
এক বিদেশি খুব ভালভাবে ব্যাকরণগতভাবে বাংলা ভাষাটা রপ্ত করল। কথা প্রসঙ্গে,তার বাসায় কাজ করত একটা ছোটো বাংলাদেশি ছেলেকে বলল -"তোমার চেয়ে আমি অনেক ভাল বাংলা বলতে পারি এখন।তখন সেই ছোট ছেলেটা বলল- স্যার,আপনি সারা জীবন বাংলা শিখলেও আমার চেয়ে ভাল বাংলা বলতে পারবেন না।তিনি বলল তাই নাকি? সে বলল জী,স্যার।তখন বিদেশি বলল তুমি কি এমন জানো যেটা আমি জানি না।ছেলেটা বলল চলেন স্যার আপনার বাংলা জানার পরিক্ষা নেই।
ছেলেটা বিদেশিকে একটা নদীর পারে নিয়ে গেলেন।তারপর বলল, ওই যে নদীর ওপারে মাঝিটা যে নৌকা নিয়ে বসে আছে, তাকে বলেন এপারে এসে আপনাকে নদী পার করে নিয়ে যেতে। বিদেশি বলল এটা আর এমন কি বিষয়।বিদেশি ডাকা শুরু করল-
" ও হে কান্ডারি! তুমি তোমার তরী লইয়া তটে আসো।সমবিহরে পার হইয়া যাইবা।"
মাঝি তো কোন কথাই শুনে না।মাঝির চোদ্দগুষ্টি এই কথা শুনে নাই সে আর কি জবাব দেবে সে তার মত চুপ করে আছে। তিনি আবার ডাকল তাও মাঝি শোনে না।এভাবে কয়েকবার ডাক দিলেন কিন্তু মাঝি শুনল না।এরপর ছেলেটা বলল- স্যার এবার আমি ডাকি।ছেলেটা মাঝি কে বলল- ও মাঝি ভাই,একটু ওপারের পার করে দাও। মাঝি বলল, খাড়ান! আইতাছি।
গল্পের মূল কথা হল- বিদেশি যে বাংলা ভাষা জানে না, সেটা কিন্তু নয়। সে অনেক ভাল বাংলা জানে। কিন্তু কোন জায়গায় কোন শব্দ বলা দরকার সেটা সে বোঝে নাই। আর ছেলেটার রক্তে বাংলা.....
তাই শব্দচয়ন বড় একটা ব্যাপার।
পরিশেষে একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করবো। বুখারি শরিফের হাদীস নং-৩৬১০, মুসলিম শরিফের হাদীস নং- ১০৬৪, যেই হাদীস শরীফখানায় বলা হয়েছে, জুল খুয়াইসরা আত তামিমি সম্পর্কে। যে কালিমাতে বিশ্বাসী মুসলমান ছিল, নামাজ পড়ত অনেক বেশি, কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করত অনেক বেশি, বাহ্যিক সুন্নাতের অনুসরণ করত অনেক বেশি। কিন্তু প্রিয় নবিজী ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নাম ধরে ডেকে সে আদেশ দিয়েছিল এই বলে, "হে মুহাম্মাদ আপনি ন্যায়বিচার করুন!" সাথে সাথে খারেজিদের পূর্বপুরুষে পরিণত হয়েছে। হজরত আবু সায়িদ খুদরি রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ও অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম থেকে অনেক অনেক সনদে ও রেওয়ায়াতে এসেছে এই হাদীস শরীফখানা।
শব্দচয়নের জন্য শুধু ফেত্না হবে তা নয়, বরং আপনি নিজেই সামান্য ভূলের জন্য মুরতাদ তথা কাফেরে পরিনত হতে পারেন।তাই বাংলাদেশের সেলিব্রিটি ইসলামিক বক্তাদের উচিত শব্দচয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া।বিশেষ করে হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আহলে বাইত শরিফ উনাদের ব্যাপারে।
নিম্নে কয়েকটি হাদিস শরিফ দেয়া হলোঃ
১.প্রথমতো রাসুলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার নাম মুবারক উচ্চারন বা স্মরণ করার আদব রক্ষা করা ফরজ, কারণ মহান আল্লাহ পাক বলেনঃ
অর্থঃ (হে ইমানদারগণ) তোমরা একে অপরকে যেভাবে আহ্বান করে থাকো, সেভাবে হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আহ্বান করো না। [সূরাহ নূর শরীফঃ ২৪/৬৩]
২. মহান আল্লাহ পাক উনি হযরত উম্মাহাতুল মুমিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনাদের শানে মুবারক আয়াত নাযিল করে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিলেনঃ
অর্থঃ হে নবী পত্নীগণ! আপনারা অন্য নারীদের মত নন। [সূরাহ আল আহযাব শরীফঃ ৩৩/৩২] অর্থাৎ হযরত উম্মুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনারা যমিনের কোন মহিলাদের মত নন। উনাদের মর্যাদা সমস্ত মুমিন মহিলাদেরও ঊর্ধে।
৩. হাদীছ শরীফে রসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আহলে বাইত শরীফ আলাইহিমুস সালাম উনাদের (উম্মুল মুমিনীন আলাইহিন্নাস সালাম উনারাও আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত) স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেনঃ
অর্থঃ আমি তোমাদেরকে আমার আহলে বাইতের ব্যাপারে মহান আল্লাহ পাক উনার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। [সহীহ মুসলিম শরীফ, হাদীছ শরীফ নং ২৪০৮]
কেউ যদি মহান আল্লাহ পাক, রাসূলে পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উম্মুল মু’মিনিন আলাইহিন্নাস সালাম, খোলাফায়ে রাশেদিন আলাইহিমুস সালাম, সাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু, তাবেঈ তবে তাবেঈন রহমাতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের শানে আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করে, মনগড়া কিচ্চা কাহিনী বলে,সে সাথে সাথেই মুরতাদ তথা কাফেরে পরিনত হয়ে যাবে -এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।