সুওয়াল-৯: মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদের জমি রাস্তা-ঘাট, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, নদী রক্ষণাবক্ষেণ বা সরকারী-বেসরকারী যে কোনো প্রয়োজনে স্থানান্তর করা জায়িয আছে কি?



জাওয়াব: মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র শরীয়ত উনার দৃষ্টিতে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদের জমি রাস্তা-ঘাট, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, নদী রক্ষণাবক্ষেণ বা সরকারী-বেসরকারী যে কোনো প্রয়োজনে স্থানান্তর করা জায়িয নেই। কারণ মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদের জমি বা মসজিদের জন্য ওয়াকফকৃত জমি উনার একমাত্র মালিক হচ্ছেন স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক তিনি। এখানে যদি কখনো মসজিদ ঘর নাও থাকে কিন্তু জমিটি কিয়ামত পর্যন্ত মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদের জমি হিসেবেই থাকবে এবং মহাপবিত্র ও মহাসম্মানিত মসজিদ হিসেবে সংরক্ষণ করা ফরয। ব্যতিক্রম করা কাট্টা কুফরী। উক্ত স্থানে রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি ইত্যাদি করা, উক্ত জমি স্থানান্তর বা বিক্রি করা, পরিবর্তন করা কখনোই জায়িয হবেনা বরং কাট্টা হারাম ও কুফরী হবে।
এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক তিনি ইরশাদ মুবারক করেন-
وَمَنْ اَظْلَمُ مِـمَّنْ مَّنَعَ مَسٰجِدَ اللهِ اَنْ يُّذْكَرَ فِيْهَا اسْـمُهٗ وَسَعٰى فِـىْ خَرَابِـهَا اُولٰٓئِكَ مَا كَانَ لَـهُمْ اَنْ يَّدْخُلُوْهَا اِلَّا خَآئِفِيْنَ لَـهُمْ فِـى الدُّنْيَا خِزْىٌ وَّلَـهُمْ فِى الْاٰخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيْمٌ.
অর্থ: “ওই ব্যক্তির চেয়ে বড় যালিম আর কে? যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদ মুবারকসমূহে উনার যিকির মুবারক করতে, উনার সম্মানিত নাম মুবারক উচ্চারণ করতে বাধা দেয় এবং সেগুলোকে বিরান করতে চেষ্টা করে। (অর্থাৎ মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদ ভেঙ্গে ফেলে বা বন্ধ করে রাখে, হক্ব আদায় করে না তা’যীম-তাকরীম করে না) তাদের জন্য ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায় অর্থাৎ খালিছ তওবা-ইস্তিগফার করা ব্যতীত মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদ মুবারকসমূহে প্রবেশ করা জায়িয নেই। তাদের জন্য রয়েছে ইহকালে লাঞ্ছনা এবং পরকালে কঠিন শাস্তি।” সুবহানাল্লাহ! (পবিত্র সূরা বাক্বারা শরীফ : পবিত্র আয়াত শরীফ ১১৪)
উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার ব্যাখ্যায় বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য তাফসীর “তাফসীরে আহমদী” উনার ১৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
اِنَّـهَا تَدُلُّ عَلٰى اَنَّ هَدْمَ الْمسَاجِدِ وَ تَخْرِيْبَهَا مَمْنُوْعٌ وَ كَذَا الْمَنْعٌ عَنِ الصَّلٰوةِ وَ الْعِبَادَةِ وَ اِنْ كَانَ مَمْلُوْكَاَ لِلْمَانِعِ
অর্থ: “উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ দ্বারা বুঝা যায় যে, মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদ ধ্বংস করা বা বিরান করা নিষিদ্ধ। অনুরূপ উহাতে নামায ও ইবাদত করতে নিষেধ করাও হারাম ও কুফরী, যদিও মসজিদটি নিষেধকারীর অধীনে থাকে।”
ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব “ফতওয়ায়ে আলমগীরীর” ২য় খন্ডের ৪৪৪ পৃষ্ঠায়-
وَلَوْ كَانَ مَسْجِدٌ فِىْ مَـحَلَّةٍ ضَاقَ عَلٰى اَهْلِهٖ وَلَا يَسَعُهُمْ اِنْ سَاَلَـهُمْ بَعْضُ الْـجِيْرَانِ اَنْ يَّـجْعَلُوْا ذَالِكَ الْـمَسَجِدَ لَهٗ لَيَدْخُلُهٗ فِىْ دَارِهٖ وَ يُعْطِيْهِمْ مَكَانَهٗ عَرْضًا مَا هُوَ خَيْرٌ لَهٗ فَيَسَعُ فِيْهِ اَهْلُ الْـمَحَلَّةِ قَالَ مُـحَمَّدٌ رَحْـمَةُ اللهِ عَلَيْهِ لَايَسَعُهُمْ ذَالِكَ كَذَا فِى الذَّخِيْرَةِ
অর্থ: যদি কোন মহল্লায় একটি মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদ থাকে, তথাকার অধিবাসীদের পক্ষে উক্ত মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদে স্থান সংকুলান না হয়, এবং তারা উক্ত মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদের আয়তন বৃদ্ধি করতে সক্ষম না হয়, আর এই কারণে কোন প্রতিবেশী যদি তাদের নিকট আবেদন করে যে, তারা যেন উক্ত মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদটি তার অধিকারভুক্ত করে দেন, যাতে করে সে ব্যক্তি উহা আপন বাড়ির অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারে এবং তার পরিবর্তে সে ব্যক্তি তাদেরকে তদাপেক্ষা একটি উৎকৃষ্ট স্থান প্রদান করবে, যার মধ্যে মহল্লাবাসীদের (নামাযের) স্থান সংকুলান হবে। হযরত ইমাম মুহম্মদ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, এরূপ করাটা তাদের জন্য জায়িয হবে না। জখীরা কিতাবেও অনুরূপ বর্ণিত আছে।
ফিক্বাহের বিখ্যাত কিতাব “ফতওয়ায়ে আলমগীরীর” ২য় খন্ডের ৪৪৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে-
فِـىْ فَتَاوَى الْـحُجَّةِ لَوْ صَارَ اَحَدُ مَسْجِدَيْنِ قَدِيـْمًا وَتَدَاعِىْ اِلَـى الْـخَرَابِ فَاَرَادَ اَهْلُ السّكة بِبَيْعِ الْقَدْيـْمِ وَ صَرْفِهِ الْـمَسْجِدِ الْـجَدِيْدِ فَاِنَّه لَا يَـجُوْزُ اَمَّا عَلٰى قَوْلِ اَبِـىْ يُوْسُفَ رَحْـمَةُ اللهِ عَلَيْهِ فُلَانٌ الْـمَسْجِدِ وَاِنْ خَرَبَ وَاسْتَغْنٰـى عَنْهُ اَهْلُه لَا يَعُوْدُ اِلٰى مِلْكِ الْبَانِـىِّ وَ الْفَتْوٰى عَلٰى قَوْلِ اَبِـىْ يُوْسُفَ رَحْـمَةُ اللهِ عَلَيْهِ اِنَّه لَايَعُوْدُ اِلٰى مِلْكِ مَالِكٍ اَبَدًا كَذَا فِى الْـمُضْمِرَاتِ
অর্থ: ফতওয়ায়ে হুজ্জত নামক কিতাবে আছে, যদি দুইটি মসজিদ উনার মধ্যে একটি পুরাতন হয় ও বিরাণ হয়ে যায়, অতঃপর গ্রামবাসীরা মসজিদটি বিক্রি করে উহার মূল্য নতুন মসজিদে ব্যায় করার ইচ্ছা পোষণ করে, হযরত ইমাম আবূ ইউসূফ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মতানুসারে উহা জায়িয হবেনা। কেননা যদিও একটি মসজিদ বিরান হয়ে যায় এবং উহার পরিচালকগণ উহার পরিচালনা ছেড়ে দেন তাহলেও উক্ত মসজিদ উহার নির্মানকারীর অধিকারভুক্ত হতে পারেনা। ইমাম আবূ ইউসূফ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মতের উপরেই ফতওয়া। এক্ষেত্রে উক্ত মসজিদ কখনো কোন ব্যক্তি মালিকের অধিকারভুক্ত হবেনা। ইহা মুজমারাত কিতাবেও আছে। অর্থাৎ কারো পক্ষেই উক্ত মসজিদ বিক্রি বা স্থানান্তর করার অধিকার নেই। কারণ ওয়াক্বফকৃত স্থানে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদ থাকুক বা না থাকুক সে স্থানটির মালিক হচ্ছেন স্বয়ং মহান আল্লাহ পাক তিনি। (উক্ত মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র স্থানটুকু সংরক্ষণ করা সকলের জন্যই ফরয বিপরীত করা কাট্টা কুফরী ও হারাম)
“ফতওয়ায়ে শামী”, ৩য় খন্ড ৭৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে
( وَلَوْ خَرَبَ مَا حَوْلُه الخ) اَىْ وَلَوْ مَعَ بَقَائِهٖ عَامِرًا وَكَذَا لَوْ خَرَبَ وَلَيْسَ لَه مَا يَعْمُرُبِهٖ وَقَدْ اِسْتَغْنَى النَّاسَ عَنْهُ لِبِنَاءِ مَسْجِدٍ اٰخَرٍ (حَوْلَه عِنْدَ الْاِمَامِ وَالثَّانِـىِّ) فَلَا يَعُوْدُ مِيْرَاثًا وَلَا يـَجُوْزُ نَقْلُه وَ نَقْلُ مَالِهٖ اِلٰـى مَسْجِدٍ اُخَرٍ سِوَاءٍ كَانُوْا يُصَلُّوْنَ فِيْهِ اَوْ لَا وَهُوَ الْفَتْوٰى حَاوِىٍ قُدْسِىٍّ وَاَكْثَرُ الْـمَشَائِخِ عَلَيْهِ مُـجْتَبٰـى وَ اِلَّا وَجْهَ فَتْحٍ بـَحْرٍ
অর্থ: যদি মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদ উনার পার্শ্ববর্তী স্থান বিরাণ হয়ে যায়, কিন্তু মসজিদটি স্থায়ী থাকে, এমনভাবে যে, যদি মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদ বিরাণ হয়ে যায় এবং উহার সংস্কার করার কোন উপায় না থাকে, লোকজন অন্য মসজিদ তৈরী করেছে এজন্য উহাতে নামায পড়া ত্যাগ করে থাকে, তবে ইমাম আবূ হানীফা রহমতুল্লাহি আলাইহি ও ইমাম আবূ ইউসূফ রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের মতে উক্ত মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদ কোনো উত্তরাধিকারীর অধিকারভুক্ত হবেনা। এবং উক্ত মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদ এবং উহার সম্পত্তি অন্য কোনো মসজিদে স্থানান্তরিত করাও জায়িয হবেনা। লোকজন উহাতে নামায পড়–ক আর নাই পড়–ক। হাবী কুদছী এর উপরেই ফতওয়া দিয়েছেন। মুজতবা বলেন- অধিকাংশ প্রাচীন আলিম উনারা এই মত সর্মথন করেছেন। ফতহুল ক্বদীরে আছে ইহাই সমধিক যুক্তিযুক্ত মত। ইহা বাহরুর রায়েকেও আছে। যদি বিরান মসজিদও স্থানান্তরিত করা জায়িয না হয় তবে চালু বা সচল মসজিদ স্থানান্তরিত করা জায়িয হয় কিভাবে?
উপরোক্ত দলীল ভিত্তিক আলোচনা দ্বারা অকাট্যভাবেই প্রমাণিত হলো যে, মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদ উনার একচ্ছত্র মালিক যেহেতু মহান আল্লাহ পাক তিনি, তাই কোনো অবস্থাতেই অন্য কারো জন্য মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদ উনার জায়গা স্থানান্তরিত করা অর্থাৎ রাস্তা-ঘাট, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, নদী রক্ষণাবক্ষেণ বা সরকারী-বেসরকারী যে কোনো প্রয়োজনে মহাসম্মানিত ও মহাপবিত্র মসজিদ উনার জায়গা স্থানান্তরিত করা জায়িয নেই বরং হারাম ও কাট্টা কুফরীর অন্তর্ভুক্ত।
দলীলসমূহ: ১. তাফসীরে ত্ববারী শরীফ, ২. তাফসীরে খাযিন শরীফ, ৩. তাফসীরে বাগবী শরীফ, ৪. তাফসীরে মাযহারী শরীফ, ৫. তাফসীরে আহমদী শরীফ, ৬. তাফসীরে সামারকন্দী শরীফ, ৭. তাফসীরে জালালাইন শরীফ, ৮. তাফসীরে দুররে মানছূর শরীফ, ৯. তাফসীরে নিশাপুরী, ১০. তাফসীরে মাওয়ারাদী, ১১. মাজমাউয যাওয়াইদ, ১২. জামি‘উছ ছগীর, ১৩. ফাতহুল কাবীর, ১৪. জামি‘উল আহাদীছ, ১৫. কাশফুল খফা, ১৬. আল মাত্বালিবুল আলিয়াহ, ১৭. কানযুল ‘উম্মাল, ১৮. সুনানুল কুবরা লিল বাইহাক্বী, ১৯. মুছান্নাফে আবী শায়বা, ২০. শুয়াবুল ঈমান, ২১. ত্ববারানী শরীফ, ফতওয়ায়ে আলমগীরী, ২২. ফতওয়ায়ে হিন্দিয়া, ২৩. ফতহুল ক্বাদীর, ২৪. জাওহারাতুন নাইয়্যারাহ, ২৫. বাহরুর রায়িক, ২৬. আইনী, ২৭. ইনায়া, ২৮. আইনুল হিদায়া, ২৯. হিদায়া মায়াদ দিরায়াহ, ৩০. দুররুল মুখতার, ৩১. কুদরী, ৩২. ফতওয়ায়ে দেওবন্দ ইত্যাদি।
বি: দ্র: এখানে সংক্ষিপ্তাকারে জাওয়াব দেয়া হলো। প্রয়োজনে আরো দলীলসহ বিস্তারিতভাবে ফতওয়া প্রদান করা হবে। ইনশাআল্লাহ!

শেয়ার করুন
পূর্ববর্তী পোষ্ট
পরবর্তী পোষ্ট