মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর পরিচালিত জান্তা সরকারে গণহত্যার বিষয়টি সামনে রেখে আন্তর্জাতিক আইনের কার্যক্রম গতি পাচ্ছে। ৫৭ সদস্যবিশিষ্ট ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সমর্থনপুষ্ট হয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার জন্য হেগস্থ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত তথা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিজে (আইসিজে) আবেদন দাখিল করেছে গাম্বিয়া।
আবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সামগ্রিক বা আংশিকভাবে হত্যাকাণ্ড, শারীরিক ও মানসিক অবস্থার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর কাজ, সন্তান জন্মদানে বাধা প্রদান, বাধ্যতামূলক স্থানান্তরের মতো কাজের মাধ্যমে ‘কনভেনশন অন দি প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দি ক্রাইম অব জেনোসাইড’-এর আওতায় থাকা বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করেছে।
আইসিজে হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটরের অনুরোধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নির্যাতনসহ অপরাধগুলো তদন্তের জন্য বিচারক নিয়োগের অনুরোধ পাওয়ার পর কাজ শুরু করেছে। বাংলাদেশ এই আদালতে যোগদানের পরই কেবল আংশিকভাবে এই দেশেও হওয়া অপরাধগুলো নিয়ে কাজ করার কিছুটা এখতিয়ার পাবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিপরীতে আইসিজে ব্যক্তির ওপর নয়, বরং রাষ্ট্রের ওপর গুরুত্বারোপ করে। এই আদালত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো শুনে আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে ‘পরামর্শমূলক অভিমত’ দেয়। এই আদালত ভারত ও পাকিস্তান এবং বলিভিয়া ও চিলির মধ্যকার শুনানিতে ব্যস্ত রয়েছে। এছাড়া অপেক্ষমাণ তালিকাটিও দীর্ঘ। আইসিজে সরাসরি মিয়ানমারের জেনারেলদের অভিযুক্ত করতে পারবে না, তবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যে মিয়ানামরের গণহত্যা চালানোর জন্য দেশটি দায়ী কিনা।
সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ তথ্যানুসন্ধান মিশন তার দাখিল করা চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলেছে যে গণহত্যার উদ্দেশ্য-সংবলিত প্রমাণ জোরালোভাবে বিদ্যমান এবং গণহত্যামূলক কাজ হয়ে থাকার সমূহ ঝুঁকি আছে। ২৩ অক্টোবর চেয়ার অব দি মিশন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জানায় যে রাখাইন রাজ্যে এখনো অবস্থান করতে থাকা প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গার অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে। মিশনটির কার্যক্রম এখন চলছে চলমান জাতিসংঘ-প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেশন মেকানিজম ফর মিয়ানমারের মাধ্যমে। আইআইএমএম প্রমাণ সংগ্রহ করে জাতীয়, আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক আদালত বা ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারকাজ পরিচালনা করার ফাইল প্রস্তুত করছে। আইসিজে সম্ভবত মিশন ও আইআইএমএমের কার্যক্রমের ওপর চলা অব্যাহত রাখবে।
আর গাম্বিয়ার আবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে ২০১৬ সাল থেকে এবং বিশেষভাবে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা জনসাধারণের ওপর ব্যাপক আকারে শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এর ফলে সাত লাখ ৪০ হাজার লোক বাংলাদেশে চলে গেছে। এত ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনসহ পুরাতন ঘটনা ও রাজনীতির উল্লেখ করার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগও আনা হয়েছে। আবেদনে জাতিসংঘ তথ্যানুসন্ধান মিশনের ঘরবাড়ি ধ্বংসসাধন, লোকজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, প্রবীণ ও শিশুদের টার্গেট করা, গণধর্ষণসহ অন্যান্য ধরনের যৌন নিপীড়নের মতো প্রমাণগুলোও জুড়ে দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০১৭ সালের আগস্টে ওইসব অপরাধ ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে যায়। আর প্রাপ্ত প্রমাণে দেখা যায়, এসব কাজ করা হয়েছিল রোহিঙ্গা লোকজনকে হত্যা করতে কিংবা মিয়ানমার থেকে তাড়িয়ে দিতে।
এই মামলায় আইজেসির এখতিয়ার থাকবে। কারণ গাম্বিয়া ও মিয়ানমার উভয়েই জেনোসাইড কনভেনশনের পক্ষ। কনভেনশনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বিবদমান পক্ষগুলো তাদের বিরোধ আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে তাদের অবস্থান পেশ করবে।
এই প্রথমবারের মতো কোনো গণহত্যায় সরাসরি আক্রান্ত নয়, এমন দেশও কোনো মামলা আইসিজের কাছে নিয়ে গেল। অবশ্য বিরোধটি আইসিজের এখতিয়ারভুক্ত। কারণ গণহত্যা কনভেনশনের শর্তানুযায়ী, এ নিয়ে আবেদন দাখিল করতে পারে। মিয়ানমারও এর বিরুদ্ধে আবেদন দাখিল করতে পারে। তবে তারা কিভাবে তা করতে পারে, তা স্পষ্ট নয়। আবার তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের শুনানিতে অনুপস্থিত থাকতে পারে, কিন্তু আইসিজেতে এর অবকাশ নেই।